আজকের লেখায় থাকছে, কর্মকর্তার সংখ্যার দিক থেকে দেশের বৃহত্তম এই ক্যাডারের আদ্যোপান্ত।
চাকুরিতে যোগদানের পর একজন শিক্ষা ক্যাডারভূক্ত কর্মকর্তা দেশের সরকারি কলেজসমূহে প্রভাষক হিসেবে পদায়ন লাভ করে থাকেন। পরবর্তীতে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী তারা সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, এবং সর্বশেষ অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করে থাকেন।
শিক্ষা ক্যাডারদের সবাই যে শুধু শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকেন, তাও নয়। যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিম্নোক্ত মর্যাদাপূর্ণ পদ গুলোতে শুধু শিক্ষা ক্যাডাররাই নিয়োগ লাভের সুযোগ পান–
১. দেশের সকল শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল পদ
২. মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ( মাউশি), যা কিনা দেশের সকল সরকারি বেসরকারি হাইস্কুল কলেজ পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ; এর মহাপরিচালক, পরিচালক , এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ
৩. জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী(নায়েম), যা দেশের সকল সরকারি বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকদের প্রশিক্ষন প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত; এর মহাপরিচালক, পরিচালক সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ
৪. জাতীয় কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ( এনসিটিবি), যা দেশের সকল স্কুল কলেজের বই প্রকাশ, পরিমার্জন, পরিবর্ধন এর দায়িত্বে নিয়োজিত; এর চেয়ারম্যান, সদস্যসহ সব গুরুত্বপূর্ণ পদ
৫. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদ
৬.এছাড়াও
— শিক্ষা ক্যাডারে যোগদানের পর অনেকদিন মাস্টারি করার পর এই চাকুরী আর ভাল না লাগলে সহযোগী অধ্যাপক হবার পর আপনি চাইলে নির্দিষ্ট কোটার সুবিধা নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে উপসচিব পদে যোগদান করতে পারেন। যেখান থেকে আপনি জেলা প্রশাসক (ডিসি), সচিব ইত্যাদি হিসেবে পদোন্নতি লাভ করাসহ সচিবালয় এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরসমূহে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেতে পারেন। ( যেমনঃ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান অতিরিক্ত সচিব মোল্লা জালাল স্যার শিক্ষা ক্যাডারেরই একজন সদস্য) তাই শিক্ষা ক্যাডার মানেই আজীবন মাস্টারি,এটা নিতান্তই ভুল ধারনা।
– অধ্যাপক হবার পর আপনি দেশের কোন একটা কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ লাভের যোগ্যতা অর্জন করলেন। আর অধ্যক্ষ হলেন একটা সরকারি কলেজের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী, যা বলাই বাহুল্য।
আয় উপার্জনঃ
একজন বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে অন্য সব ক্যাডারের সমান বেতনের পাশাপাশি আপনার জন্য এখানে রয়েছে লোভনীয় কিছু সুযোগ সুবিধার অনন্য বন্দোবস্তঃ
১.পরীক্ষার হলে ইনভিজিলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন ও খাতা মূল্যায়নঃ সরকারি কলেজসমূহে এইচএসসি, ডিগ্রী, অনার্স, মাস্টার্স মিলিয়ে সারাবছর জুড়ে এপরীক্ষা ও পরীক্ষা লেগেই থাকে। একটু কষ্ট স্বীকার করে পরীক্ষার হলে দায়িত্বপালন ও খাতা মূল্যায়ন করলে সারাবছর ধরে গড়ে প্রতিমাসে দশ–পনেরো হাজার টাকা সহজেই পাওয়া যাবে।
২.বিভিন্ন কমিটিতে দায়িত্বপালনঃ আপনি প্রতিবছর গড়ে দুই-তিনটা কমিটির আহবায়ক /সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাবেন। যেমন ক্রয় কমিটি, টেন্ডার কমিটি, স্পোর্টস কমিটি, কালচারাল কমিটি, ভর্তি কমিটি, ফরমফিলাপ কমিটি, পরীক্ষা কমিটি, বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন কমিটি ইত্যাদি। দুয়েকটি কমিটি নন-রেমুনারেটিভ হলেও বেশিরভাগ কমিটিতে দায়িত্ব পালনের জন্য একটি ভাল অংকের টাকা পকেটে পোরার নিশ্চয়তা থাকবে।
– প্রাইভেটও অন্যান্য: সরকার শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন আংশিক নিষিদ্ধ করলেও শর্তসাপেক্ষে সেই সুযোগ এখনো রয়েছে। অবসর সময় ছাত্রছাত্রীদের কোচিং ক্লাসে পড়িয়ে আপনি আপনার মানিব্যাগ স্ফীত করে তুলতে পারবেন।
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, সৎপথে জীবনধারন যদি আপনার ব্রত হয়ে থাকে, তাহলে শিক্ষা ক্যাডারের চাইতে অধিক উপার্জনের নিশ্চয়তা আপনাকে কোন ক্যাডার দিতে পারবে না।
উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণঃ
অন্যসব ক্যাডারের মতোই সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার্থে গমনের ক্ষেত্রে আপনিও সমান সুযোগ লাভ করবেন। নায়েমের ভিআইপি সুযোগসুবিধা সংবলিত বুদ্ধিজীবী হোস্টেলে অবস্থান করে গ্রহন করবেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের মৌলিক প্রশিক্ষন। এছাড়া কদিন পরপর এ ট্রেনিং ও ট্রেনিং তো লেগেই থাকবে। ( সেখানে আকর্ষণীয় ট্রেনিং ভাতার বন্দোবস্তও যে থাকবে,সে কথা না হয় না–ই বললাম।)
অন্যান্যঃ
–প্রফেশনাল ক্যাডারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেহেতু শুধু আপনার বিষয়ের প্রার্থীগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাই লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভায় সাধারণ ক্যাডারসমূহের ( পুলিশ,প্রশাসন, পররাষ্ট্র ইত্যাদি) তুলনায় কম মার্কস নিয়ে আপনি শিক্ষা ক্যাডার পেতে পারেন।
– আপনি যেখানে চাকুরী করবেন, সেই এলাকায় আপনার পরিচিতি ও আকাশচুম্বী গ্রহণযোগ্যতা অন্য যে কোন ক্যাডারের লোকেদের ঈর্ষার উদ্রেক করবে নিঃসন্দেহে। যার নমুনা আপনি টের পেয়ে চলবেন রিকশায় উঠতে, চায়ের দোকানে, রাস্তা-ঘাটে সর্বত্র । সালাম অনেকেই পান/পাবেন। তবে অন্যদের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ সামনে সালাম — আড়ালে গালির নীতি অনুসরণ করলেও আপনাকে দেওয়া সালামটা হবে হৃদয় নিঃসৃত ও স্বতঃস্ফূর্ত। ছাত্রছাত্রীদের বাসায় দাওয়াত খাবেন, ডিসি-এসপি স্যারদের সাথে জেলার আইনশৃঙ্খলা মিটিংসহ সকল সরকারি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধি হিসেবে ( কখনোকখনো ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ) পরিদর্শন করবেন, আপনার নিকট লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা না দিয়ে, আপনার ইচ্ছার বাইরে ওই জেলায় একজন স্কুল কলেজের শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ নেই। জনগণ সত্যায়িত করার জন্য লাইন দিবে, আপনি আপনার সাধ্যমত সহযোগিতা করে মানুষের দোয়া অর্জন করবেন। না পারলে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন।
অসুবিধাঃ
—————
সত্যিকারার্থে শিক্ষা ক্যাডারের কোন অসুবিধা আমি দেখি না। কারন এ ক্যাডারে থেকেও চাইলে আপনি তথাকথিত ক্ষমতার মালিক হতে পারবেন, অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ না থাকাটা যাদের নিকট অসুবিধা মনে হয়, আমি মনে করি, শিক্ষা ক্যাডার তো নয়ই, তাদের সিভিল সার্ভিসে আসাই উচিত নয়। তবে হ্যাঁ—
১.আমি মনে থেকে বিশ্বাস করি, অন্তত প্রতিটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ স্যারদের জন্য একটা গাড়ি থাকা প্রয়োজন। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের প্রভাষক পদে চাকুরী করার সময় দেখেছি, জেলা প্রশাসন আয়োজিত বিভিন্ন সভাসমিতিতে অন্য ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তারাও যেখানে গাড়ি নিয়ে আসেন, সেখানে ওই জেলার সবচে জ্যেষ্ঠ ক্যাডার কর্মকর্তা, বয়োবৃদ্ধ অধ্যক্ষ স্যারেরা যোগ দেন পায়ে হেঁটে এসে। বিষয়টি আমার কাছে খুব অপমানজনক মনে হত।
২.আরেকটা বিষয় বেশ পীড়াদায়ক। সবাই এক কথায় বলে দেন, শিক্ষা ক্যাডার অফিসাররা নাকি সারাবছর শুধু ছুটিই কাটান। এই কথাটি বাস্তবতাসম্পন্ন তো নয়ই, বরং সত্যের অপলাপ মাত্র। যে গ্রীষ্মকালীন, শীতকালীন এবং অন্যান্য লম্বা ছুটিছাটা নিয়ে এত কথকতা, বাস্তবে দেখা যাবে তার প্রত্যেকটি জুড়েই থাকছে কোন না কোন পাবলিক পরীক্ষা। প্রতিটি পরীক্ষায় ইনভিজিলেটরের দায়িত্ব পালন করার বাধ্যবাধকতা তো আছেই, কখনো কখনো কাজ করতে হয় পরীক্ষা কমিটির আহবায়ক /সদস্য হিসেবে। বেশিরভাগ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা প্রতি চার বছর অন্তর প্রাপ্য শ্রান্তিবিনোদনের ছুটিটুকুও পান না। এত কিছুর পরও সরকারিভাবে শিক্ষা ক্যাডার একটি অবকাশ বিভাগ হিসেবে গণ্য, যার ফলে এই ক্যাডারের কর্মকর্তাবৃন্দ পেনশন সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও শিক্ষকরাই সর্বোচ্চ বেতন ও মর্যাদা পাবার অধিকারী। আমাদের দেশে সেরকম কিছু তো নেইই, বরং যতটুকুই বা আছে, তা নিয়েও দুদিন পরপর টালবাহানা শুরু হয়ে যায়।
৩. এরপর আছে কোন বেসরকারি কলেজকে সরকারিকরন করা হলে সেখানকার শিক্ষকদের ঢালাওভাবে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে আত্মীকরণ। কোন সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হলে গুটিকয়েক ছাড়া বাকি টিচারদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নতুন টিচার নিয়োগ দেওয়া হয়( যেমন জগন্নাথ ভার্সিটি), আর যে ক’জন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মীকৃত হবার এই মহার্ঘ্য সুযোগটি পান তাদেরকেও হাজার রকমের শর্ত পূরণ করে, নানা ঘাটের জল খেয়ে তবেই আসতে হয়। অথচ কলেজ সরকারিকরনের সময় সেই নিয়মই আবার উলটে যায় ১৮০ ডিগ্রী এঙ্গেলে। এক্ষেত্রে কোনরকম বাছবিচার ও যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার বালাই নেই। যোগ্যদের পাশাপাশি অনেক অযোগ্যরাও তখন রাতারাতি বিসিএস ক্যাডার বনে যান।
শুধু তাই নয়, আত্মীকৃত হবার পর সেই ডিগ্রি পাস শিক্ষক বিভাগীয় শহরসমূহের বড় কোন কলেজে বদলি হওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন। কারন বর্তমান কলেজে উনি যতদিন থাকবেন, ততদিন আত্মীকৃত তকমা তার গায়ে সেঁটে থাকবে। সবাই বলবে উনি আত্মীকৃত বিসিএস ক্যাডার। আত্মীকৃত হবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি না রাখলেও এখন সেটি স্বীকার করতে তার দুনিয়ার সংকোচ!!! তাই এ কলেজ থেকে বিভাগীয় শহরের নামজাদা কলেজে বদলি হওয়ার মাধ্যমে কলঙ্কমোচনের এই প্রাণান্ত চেষ্টা।
অব্যাহত এ দৌড়ঝাঁপে সফল হয়ে একসময় তিনি তার কাঙ্ক্ষিত কলেজে চলেও যান। আর কয়েক লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যোগ্যতার প্রমান দিয়ে ক্যাডার সার্ভিসে জয়েন করা হতভাগা ছেলেটা পোস্টিং পায় প্রত্যন্ত উপজেলায় সেই আত্মীকৃত শিক্ষকের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত পোস্টে। কী বলবেন এটাকে! মেধার যুদ্ধে বিজয়ী হবার অপরাধের শাস্তি !! নাকি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস!!
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৯টি কলেজকে সরকারিকরনের যে সাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেজন্য উনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে একটি মানসম্পন্ন, সহজলভ্য, বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক এ সিদ্ধান্তকে আরো অর্থবহ করতে ওই কলেজগুলোতে আত্মীকৃত শিক্ষকের বদলে প্রকৃত বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক পদায়ন করা একান্ত প্রয়োজন। আত্মীকৃত শিক্ষকদের সরাসরি ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত না করে ননক্যাডার হিসেবে নিজনিজ কলেজে চাকুরি করার সুযোগ দিলে তাদের শিক্ষকতা পেশা ও রুটিরুজির সংস্থান দুটোই অক্ষুণ্ণ থাকার পাশাপাশি শিক্ষা ক্যাডারসদস্যদের হতাশাও দূরীভূত হবে।
সবশেষে বলব, যাদের তথাকথিত ক্ষমতার মোহ নেই এবং সম্মানজনক -নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করতে চান, নিশ্চিন্তে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করতে পারেন।
উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে বাংলাদেশ যেভাবে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে, আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, শিক্ষা ক্যাডারের সকল সীমাবদ্ধতা নিরসন হবেই। স্বপ্ন দেখি, এমন একদিন আসবে, সর্বোচ্চ সুযোগসুবিধা নিয়ে শিক্ষা ক্যাডারই হবে মেধাবী তরুনদের প্রশ্নাতীতভাবে একনম্বর পছন্দের ক্যাডার।একটি উন্নত, জ্ঞানভিত্তিক, কল্যান রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন পুরন করতে হলে সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন লোকেদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই। ধন্যবাদ।