বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দক্ষতার মাধ্যমে ঠিকে থাকলেও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ তাদের অদক্ষতার জন্য প্রতি্যোগীতায় ঠিকে থাকতে পারলো না। আমার মনে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর কোন এক পত্রিকার শিরোনাম ছিল, এ যেন কোকাকোলার বিজয়। মানূষের চাহিদা পুরনে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম ব্যর্থতা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ই পতন ঘঠায়। আমাদের দেশেই স্বাধীনতার পূর্বের লাভজনক বেসরকারী মিল কারখানাগুলো সরকারী হওয়ার পরই সেখানে নেমে আসে ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা। মানুষের টাকায় ভর্তূকী দিতে দিতে আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায় অথবা আবার ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। কিছু প্রতিষ্ঠানে এখনো চলছে জনগনের টাকার শ্রাদ্ধ। মরহুম অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান সাহেব একটি বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় শ্বেত হস্তি আদমজি জুট মিল বন্ধ করে দিয়ে অথচ বেসরকারী মালিকানায় এটি সবচেয়ে লাভজনক জূটমিল ছিল।বর্তমান বিশ্বের যে দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সে দেশের সর্বাধিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতার সর্বাধিক প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও প্রাইভেট ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ শুরু হয়। আমাদের দেশে যদিও এই সিস্টেম খুব বেশী দিনের না কিন্তু বিশ্বে তা অনেক পুরোনো। বর্তমান বিশ্বের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সবই প্রাইভেট।
বেসিক শিক্ষার দায়িত্ব প্রায় সব দেশেই সরকার নিলেও উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব খুব কম দেশেই সরকার নিয়ে থাকে। আমাদের দেশে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো যখন মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল তখনই কিন্ডার গার্টেন নামে দেশের আনাচে কানাচে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে যাদের অনেকেই ভাল মানের শিক্ষা নিশ্চিত করে। একইভাবে অনেক মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কলেজ গড়ে উঠে। ৯১ সালের পর থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৮৬ টী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠে। প্রথম প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিত্তশালীদের জন্যই স্থাপিত হয়েছে মনে হলেও আস্তে আস্তে ওদের প্রতি্যোগীতার ফলে তা উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের অনেকটা নাগালের মধ্যে চলে আসে। মধ্যবিত্তরা বাধ্য হয়েই সন্তানদের শিক্ষার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে যেহেতু সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ সীমিত এবং নিরাপত্তার অভাব বিস্তৃত।
ভর্তির সুযোগ না পাওয়াদের অধিকাংশই প্রাইভেটের ছাত্র হওয়াতে সবার মধ্যে একটা ধারনা জন্মে যে এরা নিম্নমানের ছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় এদের মানের খুব একটা উন্নয়ন ঘঠাতে পারবে না। শিক্ষকদের মধ্যেও যারা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ করে নিতে পারে না তারাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির রেগুলার ফ্যাকাল্টি তাই তারাও তেমন কিছু করতে পারবে না। অথচ কিন্ডার গার্টেন থেকে কলেজ পর্যন্ত প্রাইভেটে পড়ার ধারা চললেও সেখানে এই সন্দেহ এত জোরালো নয়। সরকারী স্কুল কলেজে যারা পড়ছে তারাও বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ছে। প্রাইভেট না পড়লে রেজাল্ট নির্ঘাত খারাপ হবেই। এর পরেও কেন প্রাইভেটের প্রতি এই নাক সিটকানো?

মনে পড়ছে প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর কাজ শুরুর কথা।মানুষের ভয় ছিল এই বুঝি সব টাকা নিয়ে ব্যাংক গুলো বাতাসে উড়ে যায়। অথচ আজ অধিকাংশ ক্লায়েন্ট ভুলেও সরকারী ব্যাংকের ধারে কাছে যায় না। যায় হলমার্ক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো বস্তা নিয়ে। টাকা রাখতে না বরং আনতে চিরদিনের জন্য। ঐ প্রতিষ্ঠান গুলো এখন দক্ষতার সাথে তহবিল তছরুপ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে সরকার বেইল আউটের অধীনে তাদেরকে ফান্ড দিচ্ছে আর তারা তা লূটে যাচ্ছে।

প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো তাদের প্রজ্ঞা ও দক্ষতা দিয়ে শিক্ষার্থিদেরকে বাজারের চাহিদা অনু্যায়ী বিভিন্ন ডিগ্রী প্রদান করছে। মানসম্মত গ্রাজুয়েট তৈরী করা তাদের একটি চ্যালেঞ্জ। বাজারে তাদের গ্রাজূয়েটদের চাহিদা তৈরী করতে না পারলে তাদের এনরোলমেন্ট ঝুলে পড়বে, ঠিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়বে। যে প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের প্রবৃদ্ধি নেই বুঝতে হবে সে প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েটদের বাজারে চাহিদা নেই তাদের প্রোডাক্ট মানসম্পন্ন নয়। তাই তাদেরকে সঠিকমানের গ্রাজুয়েট তৈরীর চ্যালেঞ্জ নিতেই হচ্ছে। সঠিক পরিমানে ক্লাশ নেয়া, মানসম্মত সিলেবাস, নিয়মিত গবেষণা ছাড়া শুধু বাপের তৈরী দালান কোটা দেখিয়ে যে চলা যায় না তার প্রমাণ ওয়াল্ড রেংকিং এ এসব সরকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত পিছুটান। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্টকে খাঁচার মুরগী বলে ব্যঙ্গ করছেন তাদের বিভিন্ন স্থানে জায়গা করে নেয়া। এটা ঠিক যে এখনো মেধাবিরা সরকারী প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে চাচ্ছে।

কিন্তু এই উন্নত কাঁচামালের কি দাম থাকবে যেখানে বিভিন্ন তদবিরে ২ নম্বরী মেশিন দিয়ে প্রসেসিং এর কাজ চলে। আবার অনেক কমমালের কাঁচামাল থেকেও ভাল মেশিনে প্রসেসিং এর মাধ্যমে ভাল প্রডাক্ট তৈরী করা যায়। এভাবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ভাল মানের শিক্ষক নিয়োগ করে, ভাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভাল মানের গ্রাজুয়েট তৈরী করতে পারে যা সরকারী প্রতিষ্ঠানে এখন অনেকটা অসম্ভব। কারন ওখানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এখন পাওয়া দুষ্কর। তারপর ছাত্রদের বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার, নিয়মিত ক্লাশ না হওয়া ও অন্যান্য কারনে ভাল মানের শিক্ষার্থীরাও তাদের মানকে আর ধরে রাখতে পারছে না। কিন্তু প্রাইভেটে তা পারার কথা এবং অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তা পারছে। সর্বোপরী প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মানব সম্পদের কাম্য ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে। তাই এখানে নিম্নমানের শিক্ষার্থিরা নিজেদের মানকে আর উন্নত করতে পারছে দূরদর্শী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। আজ ওয়ালিদের রেজাল্ট এর স্বাক্ষ্য বহন করে।

এর মানে সব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি যে ভাল করছে তা না। যেখানে ম্যানেজমেন্ট দূরদর্শী না সেখানে শিক্ষার মানের প্রতি লক্ষ্য না রেখে তারা স্বল্পকালীন মুনাফা অর্জনকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই বিপাকে পড়ছে। এখানে ভাল করতে হলে মানের প্রতি কোন কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। তা শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে হোক আর ছাত্রদের শিক্ষাদান ও সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষেত্রে হোক। যেন তেন প্রকারে ক্লাশ ও পরীক্ষা নিয়ে সার্টিফিকেট প্রদানই হলো সার্টিফিকেট বাণিজ্য। এ বাণিজ্য রেল স্টেশনের চায়ের দোকানের মত। এটা অতি স্বল্পকালীন।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গূলো যদি দক্ষতাকে প্রাধান্য দিতে পারে তবে অল্প দিনেই এদেশের মানূষ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম ভুলে যাবে আর বিসিএস কেন সব জায়গায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জয় করতে থাকবে। আর তা হবেই। কারন এ ব্যবসায় মুনাফাভোগী সার্টিফিকেট ব্যবসায়ীরা ঝুলে পড়বে আর মানের সাথে আপোষ না করা প্রতিষ্ঠানরাই ঠিকে থাকবে। সার্টিফিকেট যদি মানের প্রতিফলন না করে তবে এই সার্টিফিকেট যিনি অর্জন করলেন তাকে কোন অর্জনই দিতে পারবে না । আর ওয়ার্ড অব মাউথের মাধ্যমে ঐ প্রতিষ্ঠানের ভাল প্রচারনা বন্ধ হয়ে খারাপ প্রচারনা শুরু হবে যা ছাত্রদের ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। টাকার রংচং করা বিজ্ঞাপন কাউকে আর টানবে না।তবে সার্বিক জয় হবে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর।এমন দিনও আসতে পারে যেদিন দেশের দুরদর্শী নেতৃত্ব সরকারী ইউনিভার্সিটির নামে অপচয় ও অদক্ষতা মাত্রা আর না বাড়িয়ে ওগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দক্ষ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থাপনার উপর ছেড়ে দিবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ব্যবসা প্রশাসন বিভাগ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেট